রাইসুর সাথে আমার পরিচয় অল্পদিনের। চার-পাঁচ মাস হবে পরিচয় হইছে। রাইসু কে, কেমন চিন্তাধারার মানুষ, মানুষ হিসাবে কেমন—কিছুই জানতাম না। তবে, ফেসবুক টাইমলাইন ঘাইটা ধারণা হইছিল, উনি গুরুত্বপূর্ণ কেউ। উনার লেখা ভাল্লাগতো, কবিতার কিছু লাইন অদ্ভুত বিষণ্ণ করত মন। অ্যাড দিলাম, রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট হইল। সাথে সাথে একটা টেক্সটও আসল।
আমি আলাপের ব্যাপারে সাবধান থাকলাম। উনি যে বাদবাকি পাঁচজনার মতন না এই ব্যাপারটাই আমারে সতর্ক কইরা তুলছিল। রাইসুরে সকলের থিকা আলাদা করছে তার বুদ্ধিমত্তা, তার স্পষ্টবাদিতা। এইটা তার সাথে প্রথম পরিচয়েই যে কেউ বুঝবেন।
রাইসুর সাথে প্রথম দিন ফোনে আলাপ হইল অন্যান্য সমসাময়িক কবি-সাহিত্যিকদের নিয়া। আমি ছফা পড়ি, তাই ছফার আলাপও হইছে। এই আলাপের আগের দিন আমি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের দূরবীণ শেষ করছিলাম। বলছিলাম রাইসুরে। আমার পড়ার প্রশংসা করছিলেন।
আমি ওনার ফ্যামিলির কথা জিজ্ঞাসা করব কি করব না এই নিয়া দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়লাম। কথা শুইনা মনে হইতেছিল সাধারণ গড়পরতা ফ্যামিলি ওনার নাই। আবার এমন হইতে পারে—বিয়া করছিলেন, পরে সেপারেশন হইয়া গেছে।
এইসব একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় তাই আমি আগাইলাম না। কিন্তু আমারে অবাক কইরা দিয়া রাইসু ঐদিনই সব বললেন। এমন ঠাণ্ডা গলার স্বরে একজন মানুষের সত্যি কথা বলার ধরন আমারে অভিভূত করছিল।
সানজিদা আমীর ইনিসী
এই কথাবার্তার পরে আমার আইডি ডিএক্টিভেট ছিল। কথা হইছিল সকালের দিকে। আইডি ডিএক্টিভেট করছিলাম দুপুরে। পরের দিন সকালে আবার আইডি এক্টিভ করলাম। একটা স্ট্যাটাস চোখে পড়ল ওনার। প্রথম ফোনালাপে কথাপ্রসঙ্গে যখন হুমায়ূন আহমেদের কথা উঠছিল, আমি হুমায়ূন আহমেদ নাকি আহমদ এই নিয়া কনফিউজড ছিলাম। এই ব্যাপারটা রাইসুর স্ট্যাটাসের মূল উপজীব্য ছিল। আমি স্ট্যাটাস দেখার পর এক মিনিটও দেরি না কইরা রাইসুরে ফোন দিলাম। বললাম, আপনি নিজেরে যতটা সোজাভাবে দেখান, আপনি আসলে তেমন না।
উনি ব্যাখ্যা চাইলেন।
আমি বললাম, কাল ফোনেই আমার ভুল ধরায়া দিতে পারতেন, আমার কনফিউশান ছিল, আপনি সঠিকটা বললে কনফিউশান থাকত না।
রাইসু হো হো কইরা হাইসা উঠলেন।
বললেন—ও আচ্ছা! আপনার পারমিশান নেওয়া উচিত ছিল আসলে।
যেহেতু আমার নাম উল্লেখ নাই, তাই পারমিশান নেওয়া দরকার আমি মনে করি নাই। পরে অবশ্য আর এই নিয়া কথাবার্তা হয় নাই। উনি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে জানেন। কিন্তু রাগ হইয়া কথা বলতে কি জানেন? জানলেও যে তিনি রাগ কইরা কথা কন না এতটুকু আমি নিশ্চিত। এত দীর্ঘ কথাবার্তায় বা আমার অজস্র ভুলের জন্য কখনো রাইসু আমার সাথে রাগ কইরা কথা বলেন নাই।
আমার লেখালেখি শুরু হইল। রাইসু না থাকলে হইত কিনা সন্দেহ! আমি যে লিখতাম না, তা না। লিখতাম, কিন্তু এই নিয়া কোনোদিন ভাবি নাই, কোনো স্বপ্ন দেখি নাই। রাইসু জানেন, কোথা থিকা শুরু করা উচিত, কীভাবে শুরু করা উচিত।
আমাদের মাঝেমধ্যে ফোনে অনেকক্ষণ আলাপ হইত এইসব লেখালেখি নিয়া। আমি কিছুই জানি না সেইসময়। নানান রকম প্রশ্নবাণে জর্জরিত হইয়াও রাইসু কোনোদিন অধৈর্য্য হন নাই। এত ধৈর্য্য কোত্থিকা পাইছেন উনি কে জানে!
লেখালেখির আলাপ ছাড়াও আমার আলাপ, আমার ফ্যামিলি বিষয়ক আলাপ, রাইসুর জীবন, রাইসুর বিভিন্ন সময়ের প্রেম নিয়া কথাবার্তা হইত। নিঃসন্দেহে রাইসু এবং রাইসুর জীবনের ঘটনাগুলি ইন্টেরেস্টিং।
রাইসুর বলার ধরন চমৎকার। আমি আশির দশকের অনেক তথ্য রাইসুর এইসব গল্প থিকা জানছি। মাঝেমধ্যে উনারে গল্পের মাঝখানেই প্রশ্ন করি। উনি বিরক্ত হন না। প্রশ্নের উত্তর দিয়া আবার বলতে শুরু করেন।
ব্লগের নাম নিয়া (সাম্প্রতিক ডটকমে) আমি প্রতিবার টানাপোড়েনে পড়ি। রাইসু আমারে নাম ঠিক করার জন্য সময় বাইন্ধা দেন। আমি ভাবতে থাকি।
একটু পরে: “এইটা হইতে পারে?”
রাইসু—না।
আবার খানিক বাদে: “এইরকম?”
রাইসু—না।
আমি ততক্ষণে অধৈর্য্য হইয়া যাই।
ফোন দিই।
রাইসু নামের ব্যাপারে পাঁচ মিনিটের একটা বক্তব্য রাখেন। আমি প্রত্যেক কথার পরে “হু” “হু” কইরা ফোন রাইখা পুনরায় চিন্তা করি।
আবার কিছুক্ষণ পরে কিছু অপদার্থ নাম প্রস্তাব করি, তখন রাইসু ভবিষ্যৎ বাণী কইরা কন—“আপনার ছেলেমেয়েরা নামের সংকটে ভুগবে।”
আমার লেখালেখির জন্য গুগল ডক আর জিমেইলের অ্যাকাউন্টের দরকার হইল। উল্লেখ্য, আমি অ্যাকাউন্ট খুলতে জানি না। রাইসু আধা ঘণ্টা ধইরা আমারে বুঝায়া বললেন কী কী করতে হবে। মেসেনজারে স্ক্রিনশট পাঠাইলেন।
আমি কিছুক্ষণ চেষ্টা কইরা ক্ষান্ত হইলাম। ফোন কইরা বললাম, আমি পারতেছি না। সাহায্য করেন।
না, তারপর আর উনি আমারে কী কী করতে হবে বইলা সাহায্য করেন নাই একাউন্ট খুলতে।
নিজেই একাউন্ট খুইলা দিছেন।
খালি একবার কইছিলেন, “এত ব্যাকডেটেড হইলে কি চলব? এইসব শিখেন না কেন?”
ঐদিন দুপুরে শুইয়া শুইয়া ভাবতেছিলাম, রাইসুর জায়গায় আমি হইলে নিশ্চয়ই রাগ কইরা যা-তা বলতাম। শুধু আমি না, অধিকাংশ মানুষই রাগ করতেন, রাগ করাই স্বাভাবিক ছিল। আর এইটাই রাইসুর সাথে অন্যদের পার্থক্য। এইটাই রাইসুরে আলাদা করছে অন্যদের থিকা।
রাইসুর সাথে আমার পাশের বাসার আন্টিরে নিয়াও আলাপ হয়। আমাদের আলাপের বিষয় নির্দিষ্ট না। তবে, আলাপের বিষয়বস্তুর তাৎপর্য আছে। পাশের বাসার আন্টি প্রতিদিন তার গৃহকর্মীরে মারধর কইরা আমাদের আলাপের বিষয়বস্তু হইয়া উঠছিলেন।
রাইসু সবসময় ফোন কইরা প্রথমে জিগান—“কী খবর বস? আজকে কী কী হইল?”
আমি আমার কোচিং এর বৃত্তান্ত থিকা শুরু কইরা আমার আশেপাশে কী কী হইছে তার বৃত্তান্তও দিই। রাইসু শুইনা যান, কোনোরকম বিরক্তি বোধ ছাড়া অনর্গল কথা শুইনা যান।
রাইসু কথার ফাঁকফোকরে মাঝেমধ্যে জানতে চান, আমার প্রেম হইল কিনা কারও সাথে। আমি প্রত্যেকবারই একইভাবে কট্টর কণ্ঠে বলি—নাহ, হয় নাই। শস্তা নাকি!
এই জানতে চাওয়ার আর উত্তর দেওয়ার মধ্যে আগ্রহের চেয়ে কৌতুক বেশি। কেন হয় নাই, কেন মানুষের ব্যাপারে আমার ছ্যা ছ্যা বেশি, রাইসুর আমার আদৌ প্রেম হইবে কিনা এই নিয়া সন্দেহ। আমি প্রেমের ব্যাপারে কনজারভেটিভ আর তামাম(!) জীবনে একখান মাত্র প্রেম করায় রাইসুর সন্দেহ যুক্তিযুক্ত। এইসব নিয়া আমরা সিরিয়াস কণ্ঠে কিন্তু মনে কৌতুক পুইষা আলোচনা করি।
আমার মাঝখানে একজিমা হইছিল। রাইসুরে বলার পর রাইসু সমস্ত দোষ বরাবরের মত আমার খাওনদাওনের উপর চাপাইলেন। আমি কম খাই, প্রত্যেক বেলায় ঠিকমতো খাই না, ডিম দুধ খাই না, কলা খাই না—এইজন্যেই আমার অসুখ হয় বইলা রাইসুর ধারণা।
রাইসুর ধারণা অবশ্য ঠিক। শুধু যে, অসুখ হইলে আমারে উনি খাওয়াদাওয়া নিয়া বলেন, তা না। ডেইলি বলেন—“ডিম-দুধ খায়ো, বাবু!”
বাসায় বড় বড় সমস্যা হইলে পরে আমার মেজাজ খারাপ থাকে। যেহেতু আমার ফ্যামিলির সাথে আমার সম্পর্ক স্বাভাবিক না, তাই বিভিন্ন রকম ঝামেলা হইতে থাকে। রাইসু তখন মাথা গরম করতে মানা করেন, অন্তত কয়েকবার কইরা বলেন, “বস, মাথা গরম করবেন না। উনারা যা কইবেন, শুনবেন শুধু।”
রাইসুরে ভালো মানুষ মনে হওয়ার প্রথম কারণ উনার কথায় কোনোরকম লুকোচাপা নাই। নিজেরে ভালো প্রমাণ করার ঝঞ্ঝাট নেন নাই দেইখাই রাইসু ভালো মানুষ।
রাইসুর পরিচয় পাওয়া শেষ হয় নাই এখনও, আমি প্রতিদিন নতুন কইরা ওনারে জানি। আমি যেইভাবে কথা বলি, সেইভাবে লিখলে যে একটা চমৎকার জিনিস হয়, এইটা কি রাইসুর সাথে পরিচয় না হইলে জানতাম?
জানতাম-ই না হয়ত!
এইক্ষেত্রে রাইসুরে এক নতুন দ্বার উন্মোচনকারী বলা যায়। রাইসু তার সমসাময়িক কবি-সাহিত্যিকদের থিকা আলাদা, অনেক দিক থিকা আলাদা।
রাইসুরা দুর্লভ, রাইসুরা প্রতিদিন জন্মান না।
পঞ্চাশ হইলো সবে বয়স, রাইসু?
বয়সের প্রভাব থিকা আপনি মুক্ত। এই দুইটা ডিজিট দিয়া আপনার কিচ্ছু যায় আসে না—আমি জানি। আমি আরও কয়েক বছর আগে জন্মাইলাম না বইলা আফসোস হয়। বিশ বছর আগের রাইসু—যে মাইলের পর মাইল খালি পায়ে হাঁটতেন, তার সাথে হাঁটতে হাঁটতে সহস্র বার তার প্রেমে পড়া যাইত। এখন যেমন আমরা পরের জন্মের জন্য প্রেম মূলতবি রাইখা দিছি, এমন মূলতবি রাখতে হইত না।
সামনের পঞ্চাশেও লেখা দিতে চাই, তখন নিশ্চয়ই আরও অনেক লিখতে পারব প্রিয় কবির সমন্ধে। আমার এই পৃথিবী যাত্রা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এমন আদর আদর কণ্ঠে আমার হাসিরে ভালোবাইসা আমারে ‘সুহাসিনী’ ডাইকা যাইয়েন। আপনি না ডাকলে কে ডাকবে, কন?
আমি নিজেরে ধন্য মনে করতেই পারি। রাইসুর সাথে আলাপ না হইলে আজকের দিনটা ঠিক আজকের হইত না আমার জন্য।
২২ নভেম্বর ২০১৭