ব্রাত্য রাইসু একজন গ্যাডফ্লাই

ব্রাত্য রাইসুকে আমি গ্যাডফ্লাই বলেছিলাম। এতে অনেকে অসন্তুষ্ট হন।

গ্যাডফ্লাই কী? আক্ষরিক অর্থে ডাঁশপোকা, এক ধরনের পোকা যা ঘোড়াকে বিব্রত করে। প্রাচীন গ্রীসের দার্শনিক সক্রেটিস নিজেকে বলতেন গ্যাডফ্লাই।

গ্যাডফ্লাই হলেন এমন ব্যক্তি যিনি সমাজের বিরাজমান অবস্থা বিষয়ে অস্বস্তিকর সব প্রশ্ন করেন, এবং অথরিটিকে বিব্রত করেন।

চিন্তার জগতে অনেককেই গ্যাডফ্লাই বলেছেন কেউ কেউ, এই গ্যাডফ্লাইদের মধ্যে আছেন ফুকো, দেরিদা, কীয়ের্কেগার্ড, নাসিম তালেব। কীয়ের্কেগার্ড অবশ্য স্বজ্ঞানে গ্যাডফ্লাই পন্থা অনুসরণ করেন, কারণ তিনি অনুসরণ করতেন সক্রেটিসের চিন্তা-জীবন। তথাকথিত বিশেষজ্ঞরা যে সব প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে পছন্দ করেন, গ্যাডফ্লাইরা সে সব প্রশ্ন ধরেই টান দেন।

মুরাদুল ইসলাম

সাধারনত এই গ্যাডফ্লাই শব্দটি দুইভাবে ব্যবহার হয়। এক, নেগেটিভ ভাবে ঐ ব্যক্তিকে অসম্মান করতে, এবং দুই, সম্মানজনক সামাজিক দায়িত্ব পালনরত এক ব্যক্তিকে বোঝাতে।

যদ্যপি আমার গুরুতে আমরা দেখতেই পাই প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক বলছেন, “লেখার ব্যাপারটা অইল পুকুরে ঢিল ছোঁড়ার মতো। যত বড় ঢিল ছুঁড়বেন পাঠকের মনে তরঙ্গটাও ততো জোরে উঠব এবং অধিকক্ষণ থাকব।”

লেখক এই ঢিলটা ছোঁড়েন পাঠকের মানস পুকুরে। ব্রাত্য রাইসু তার ছোট ছোট লেখার মাধ্যমে বড় ঢিল ছুঁড়তেই সমর্থ হন পাঠকের মনে। কাজের ফর্ম কী (সাইজে কত বড়, ফেইসবুক স্ট্যাটাস না অন্য জায়গায় প্রকাশিত ইত্যাদি) সেদিকে লক্ষ না দিয়ে ভাবা দরকার কাজটি তার কাজ করতে পারল কি না। সেদিক থেকে দেখলে ব্রাত্য রাইসুর চিন্তামূলক লেখালেখি সফল।

গ্যাডফ্লাই যিনি, তার কাজ সব সময় এটা না যে সমস্যার সমাধান দেয়া। জিজেক দর্শনের কাজ কী বলতে গিয়ে বলেন, দর্শনের কাজ নয় সমস্যার সমাধান দেয়া, কাজ হলো আমাদের দেখানো যে, আমরা সমস্যাটিকে যেভাবে দেখি, সেটাই সমস্যার এক অংশ হতে পারে। ব্রাত্য রাইসুর চিন্তার মধ্যে এই জিনিস পাওয়া যায়, সে হিসেবে তিনি দার্শনিকও।

কগনিটিভ সাইন্সের সাম্প্রতিক গবেষণাগুলিতে দেখা যাচ্ছে, মানুষেরা তার সামাজিক গ্রুপের মত ও বিশ্বাসের বিরুদ্ধে গিয়ে যুক্তিনির্ভর সত্য বলতে চায় না। কারণ এমন কাজের জন্য তার সামাজিক গ্রুপ তাকে তিরস্কার করে এবং তাকে বের করে দিতে চায়। ফলে আইডেন্টিটি জনিত একটি সমস্যায় ব্যক্তিটি পড়ে যায়। এই ভয়েই মানুষেরা তার সামাজিক গ্রুপের মন রক্ষা করে চলে, তাদের মত ও বিশ্বাসের পক্ষে কথা বলে বাহবা পায়।

ব্রাত্য রাইসু এই পথে হাঁটেন না। ফলে, তার সামাজিক গ্রুপ তথা সামগ্রিক সাহিত্য-সংস্কৃতির দলটিতে তার প্রতি বিদ্বেষ লক্ষ করা যায়।

তবে আমার মনে হয় এতে তিনি বিশেষ ব্যথিত নন। কারণ এটাই গ্যাডফ্লাইদের নিয়তি।

প্রথম পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে ব্রাত্য রাইসুর প্রতি শুভেচ্ছা; ভালো থাকুন, এবং সুস্থ দেহ মন লয়ে ঘোড়াদের বিব্রত করতে থাকুন।

১৫ নভেম্বর ২০১৭

Leave a Reply