ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ অথবা গবেষণা সাহিত্য যেভাবে কাজ করে (১৯৯৫?)

আর গবেষকের চোখ তৈরি হয় অসংখ্য প্রশ্নচিহ্নের সমাহারে

 

ঘোড়ার কোনো শিং হয় না। ফলে আমরা বেঁচে গেছি। বেঁচে গেছে ঘোড়াও।

 

এখন এই কথাটুকু বললাম কেন? কোনো কারণ নেই। আমার বলার কথা হলো: ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিলো। এতে কারু কোনো আপত্তি নেই। আপত্তি একজন করেন। তিনি গবেষক। আপত্তি করাই তার পেশা। আমরা এই বাক্যের আলোকে তার পেশাকে বুঝতে চেষ্টা করবো। দেখি তিনি কোন পথে এগোন। গবেষক পারেন কেঁচো খুঁড়ে ঘোড়া বের করে ফেলতে। এমনকি কেঁচো না-খুঁড়েই। আমাদের পরিচিত বাস্তবতায় গবেষকের কোনো অভাব নেই। তার অনুসন্ধিৎসা প্রবল। তাই এই নেহায়েৎ অমায়িক ও তুচ্ছ বাক্যটিতেও তিনি আবিষ্কার করে ফেলতে পারেন আন্তর্মহাজাগতিক নানা ষড়যন্ত্রজাল কিংবা জীবন ও বাস্তবতার গম্ভীর সব তাৎপর্য। জগৎকে প্রমাণ করাই তার সবচেয়ে বড়ো কাজ। আসুন এই গবেষককে প্রমাণ করা যাক। তার আগে ঘোড়াকে।কিন্তু ঘোড়াকে আমরা এর মধ্যে প্রমাণ করে ফেলেছি। ঘোড়ার শিং নেই।

 

২. হাঁটিয়া চলিল

ঘোড়ায়ই যদি চড়লো তাহলে হাঁটলো কেন? এই প্রশ্ন যার মাথায় কাজ করে তিনি স্থির থাকবেন কী করে? এই বাক্য কার মধ্যে কীভাবে কাজ করলো তা দিয়ে একজন মানুষকে নির্ণয় করা সম্ভব। স্বাভাবিক যারা মানুষ তারা জিনিসটাকে এভাবে দেখবে: ও ঘোড়ায় চড়েছিল, তারপরে হেঁটেছে, বুঝলাম, তারপর…? (এ ধরনের মানুষকে বলা যায় ‘তারপর’ ধরনের মানুষ)। আর যারা ভাবুক প্রকৃতির তারা ভাববে এটা কী করে সম্ভব! এবং এই প্রশ্ন তারা তাদের বিবেকের কাছে বার বার করতে থাকবে এবং তার চেয়ে বার বার তারা বিস্মিত হতে থাকবে।(এক সময় ভুলেই যাবে কেন তারা বিস্মিত হতে শুরু করেছিল)। কিন্তু বিস্মিত হয়েই যিনি থেমে থাকবেন না তিনিই গবেষক। গবেষক অতো সহজে বোঝার লোক নন। তিনি এই বাক্যটির চৌদ্দ-গুষ্টি উদ্ধার করে ফেলবেন। এটার এক হাজার একটা ব্যাখ্যা তিনি বের করবেন এবং তা থেকে, অসুস্থ হয়ে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে, একটি সিদ্ধান্ত নেবেন। এবং এটি অতি অবশ্যই ধরে নিতে হবে, গবেষকের কোনো সিদ্ধান্ত সিদ্ধান্ত নয়, কেবল সিদ্ধান্তের একটি মহড়া মাত্র।

 

৩. গবেষকের নৃতাত্ত্বিক বিচার বা জন্মবৃত্তান্ত

প্রাচীনকালে ভূ-ভারতে একটি অত্যন্ত কার্যকর বিজ্ঞানের প্রচলন ছিল।(বিজ্ঞানকে তৎকালে বিদ্যা বলে ডাকা হতো।) এ বিজ্ঞানটি ছিল চৌর্যবিজ্ঞান এবং তা মহান বলেও বিবেচিত হতো। (সূত্র: চুরি বিদ্যা বড়ো বিদ্যা যদি না পড়ে ধরা) এবং এ সময়ে গরু চুরি বিদ্যা একটি বিশেষ মার্গ লাভ করে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তদানীন্তন চোর সকলের চুরি করা গরু অনুসন্ধানের নিমিত্তে ভিন্ন একটি বিজ্ঞান কার্যক্রম চালু হয়। সেটাই আমাদের আলোচ্য গবেষণা বিদ্যা তথা গরু অনুসন্ধান বিজ্ঞান।

 

অর্থাৎ তৎকালে গবেষকরা মূলত প্রাইভেট ডিটেকটিভের কাজ করতেন। (এখনো তাই করেন গবেষকরা। মূলত গবেষণা সাহিত্য মানেই গরুর রচনা। কেউ কেউ অবশ্য ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন।) এ জন্যই তৃণভূমি অঞ্চলে গবেষকদের সংখ্যাধিক্য দেখা যায়। গবেষণার এই প্রাচীন পদ্ধতির চর্চা এখনো গ্রামেগঞ্জে হয়ে থাকে। যদি কারু গরু হারায় তবে সে গবেষণায় বুৎপত্তি অর্জন করে।

 

৪. গবেষকের চিন্তা করার পদ্ধতি: একটি গতিশীল বিস্ময়

চিন্তা করার সাতটি জনপ্রিয় পদ্ধতি আছে। সেগুলো হচ্ছে: ১. যোগ বিয়োগ ও কৌতূহল উদ্দীপক চিন্তা করা। ২. সব দিক সম্পর্কে চিন্তা করা ৩. পরিণতি ফলাফলের কথা আগেই ভেবে নেওয়া ৪. উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট করা। ৫. সবচেয়ে সম্ভাব্য উপায় বিবেচনা করা। ৬. বিকল্প কোনো উপায় বের করা। ৭. অন্যের দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করা। (সূত্র: রহস্যপত্রিকা,কোন সংখ্যা মনে নেই।)

যিনি গবেষক, এই মাত্র সাতটি পদ্ধতিতে তিনি সন্তুষ্ট থাকবেন কেন? এই পদ্ধতিগুলো তো ব্যবহার করেনই, এছাড়া আরো কয়েকটি উপায়কে তিনি বিবেচনায় আনেন। যেমন:

১.জটিল উপায়ে চিন্তা করা

২.বোকার মতো চিন্তা করা

৩. দুশ্চিন্তা করার মতো চিন্তা করা

তো, এই হাজারো বাহানা থেকে গবেষক যেসব অবধারণসমূহ বের করবেন বা করতে পারেন আমরা তার ওপর একটু গোয়েন্দাগিরি ফলাতে পারি। বেশিরভাগ গবেষক সশব্দে চিন্তা করেন, কেউ কেউ আবৃত্তি করে। ধরা যাক কোনো গবেষকের মাথায় (গবেষকের পুরো শরীরটাই মাথা) এই সমস্যাটি কাজ করছে। এবং আমরা তার চিন্তা ভাবনাগুলো ভুলক্রমে শুনে ফেলেছি:

 

৫. চিন্তা করছেন গবেষক

গবেষকের মাথায় কিছু বিক্ষিপ্ত অনুভাবনারাশি উৎপাদিত হবে। যেমন:

আচ্ছা,ঘোড়াটি মাদী ছিলো না মর্দ ছিলো?

গবেষক যা স্থির করবেন: ঘোড়াটি আসলে মাদী ছিলো, নয়তো আলাদা করে মর্দের উল্লেখ হতো না।

আচ্ছা, ঘোড়াটির আকৃতি কেমন ছিলো?

ঘোড়াটি নিশ্চয়ই বেটে আকৃতির ছিলো। এবং যার জন্য মর্দকে নিরূপায় হয়ে এক হিসেবে হেঁটেই চলতে হয়েছে। এই অবস্থায় গবেষকের মূল্যবান মাথার ভেতর নতুন একটি সমস্যা দানা বেঁধে উঠবে। তিনি তার নোটবুকে এটি পরবর্তী কোনো সময় চিন্তার জন্য রেখে দেবেন: যে, মর্দ কোথায় গেলো?

মর্দ কোথায় গেলো চিন্তাটা অন্য আরেকটি চিন্তায় আচ্ছন্ন করবে গবেষককে। তা হলো: আচ্ছা,মর্দ রওয়ানা হয়েছিল কোথা থেকে? যেহেতু এটি বেটে ঘোড়া সেহেতু ঘোড়াটি সম্ভাব্য কোন কোন জায়গায় থাকতে পারে?

ক. যাদুঘরে? নাহ যাদুঘরে তো জ্যান্ত ঘোড়া থাকতে পারে না। নাকি পারে?

খ. বরং চিড়িয়াখানায়, কিন্তু সেসময় কি চিড়িয়াখানা ছিলো। তারচেয়ে,

গ. ঘোড়াটির পক্ষে সার্কাসের দলে থাকাই শোভন। এমনিতেই তো বেটে ঘোড়া।

তাহলে ঘোড়াটি মর্দের হাতে গেলো কী করে?

তার মানে মর্দ তা হলে ঘোড়াটিকে চুরি করেছে। ছিঃ, তার মানে তৎকালে নিশ্চয়ই চোরদেরই মর্দ বলা হতো।

 

এভাবেই জটিল চিন্তার ঘনীভবনের মাধ্যমে যে সরল সত্যে তিনি উপনীত হবেন: আদিকালে এতদঅঞ্চলে চোরদের খুব উৎপাত ছিল। চোরদের ভয়ে মানুষ চিন্তাভাবনা পর্যন্ত করতে পারতো না। চোরেরা প্রায়ই গরু চুরি করে কৃষকের চাষবাসের বারোটা বাজিয়ে দিত।এ সময় পরিত্রাণের উপায় বের করার জন্য একদল নিবেদিতপ্রাণ মানবসেবীর আবির্ভাব ঘটে। তারা হারানো ও চুরি যাওয়া গরু খুঁজে খুঁজে বের করতেন। তারা চুরি যাওয়া ঘোড়াও খুঁজে বের করতেন। তখনকার দিনে ঘোড়ারা সম্ভবত খুব বেটে আকৃতির ছিল। এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ আছে। এমনও হতে পারে যে মর্দ অর্থাৎ চোরেরা শুধু সার্কাসের ঘোড়াই চুরি করতো। অবশ্য ঘোড়াদের ব্যাপারে শেষ কথা বলা সম্ভব নয়। শেষ কথা আসলে চোরদের ব্যাপারেও বলা সম্ভব নয়। আমরা যদি মহাশয় এরিক ফন দানিকেন কথিত সুসমাচারের আশ্রয় নেই তবে দেখবো যে…

৬. চিন্তার সর্বশেষ পদ্ধতি: দানিকেন পদ্ধতি

দেখবো যে ঘোড়াটি খুব বেটে ছিল এটি হয়তো সত্য নয়। বরং মর্দদেরই পা ছিল লম্বা লম্বা। ফলে ঘোড়াদের পিঠে চড়ার পরও তাদের হাঁটতেই হতো। মর্দদের এই পৃথিবীর প্রাণী মনে করাতেই বাক্যটিকে আমাদের এতো রহস্যময় এবং অসম্ভব মনে হয়েছে। আসলে মর্দেরা ছিল ভিনগ্রহ থেকে আগত লম্বা ঠ্যাং অলা কোনো বুদ্ধিমান জীব। যাদের প্রিয় খাদ্য ঘোড়ার মাংস।

(ভোরের কাগজ পত্রিকায় খুব সম্ভব ১৯৯৫ সালে ছাপা হইছিল)

free counters
Free counters

Leave a Reply