রাইসুর আবির্ভাব

ব্রাত্য রাইসু আকারে পৃথিবীতে আগমনের ৫০ বছর উদযাপনরে অভিনন্দন জানাই। যদিও ব্রাত্য রাইসু গঠিত হওয়ার উপাদান সমূহের বয়স জগতের সমান সমান। তাঁর ১৩০ বছর বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা সে তুলনায় সামান্যই।

সাহিত্যে বংশানুগত পীরপ্রথা ভাঙিয়া রাইসুর ছক্কার বল জনতার গ্যালারিতে পড়িতেছে, সবাই ওই বল টোকাইতেছে। বাকি জিন্দেগি যাতে জনতা রাইসুকে পীরে পরিণত করিয়া ফেরকাবন্দি না করে, সেই লক্ষ্যে রাইসু বলগুলো গ্যালারির বিভিন্ন দিকে ছুঁড়িয়া দিতে পারেন। অবশ্যই এই ক্ষেত্রে ব্রাত্য রাইসুর দক্ষতা অনন্য।

মুহম্মদ আবদুল বাতেন

যাহারা মনে মনে রাইসুর প্রতি ঈর্ষা করেন, তারাও অনেকে অবশ্যই প্রকাশ্যে প্রশংসা না করে পারেন না। এতে বোঝা যায়, রাইসু নিজস্ব এবং ভিন্ন একটি মাত্রা সৃষ্টি করেছেন। মতের মাত্রাগত ভিন্নতা ব্যক্তিভেদে আলাদা হইতে পারে, কিন্তু রাইসুর চিন্তা ও উদ্ভাবনা সজীব ও আনন্দময়।

রাইসুর ভাষা ও শিল্পবোধ এই সময়ের বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ। রাইসু নিজের নিন্দা নিজেই করতে পারেন, নিজের অধিকার এবং নিজের মহত্ত্ব নিজেই ঘোষণা দিতে পারেন, নিজেকে উন্মুক্ত করে প্রকাশে তার কোনো দ্বিধা নেই। তাঁর প্রশংসা কিংবা নিন্দা করিয়া কোনো লেখা বেহুদা মনে হয়। রাইসু উন্মুক্ত।

নব্বই দশকের শুরু থেকে রাইসুর লেখা ও চিন্তার সঙ্গে আমার পরিচয় রয়েছে। আমার অন্তর্মুখী এবং নিজেকে নির্বাসিত রাখার স্বভাবের কারণে রাইসুর সঙ্গে প্রথম দিকের সেই দিনগুলোতে আমার আলাপ ও সাক্ষাৎ ঘটে নাই। ট্রেন স্টেশনের মতো পাশাপাশি দুটি ট্রেন মুভ করলেও তাদের মুখোমুখি হতে হয় না। রাইসুর সঙ্গে আমার চলা ওই সমান্তরাল যাত্রার মতোই, দেখা হলেও কথা হয় নাই। এই চলনটা আমার ভালোই লাগে, রাইসুকে বুঝতে এবং তার চিন্তা ও লেখার আস্বাদনের পরিসর পাই।

রাইসুকে বুঝতে পারাটা একটু জটিল। কারণ আমাদের প্রচলিত সাহিত্য সমাজ খুঁটি ধরে ঘোরে, সবাই একটা লাটিমের নির্দিষ্ট সীমায় সুতা ধরে ট্যাগ লাগাইয়া চলে। ডান, বাম, গোঁড়া নানা গুরুপন্থী, নানা চেতনাপন্থী—রাইসু এর মধ্যে পড়েন না। তার কর্ম, জীবন প্রণালী, লেখার ভাষা, চিন্তা পদ্ধতি সম্পূর্ণ আলাদা। পরিচিতদের কেউ কেউ আমাকে প্রশ্ন করেছে, রাইসুকে কেন পছন্দ করি, আমি বলি—রাইসু সৎ এবং মৌলিক।

রাইসুকে নিয়া অনেক গল্প, ঠিক গল্প নয়, রাইসু কেমন সেই আলোচনা আমি বহুবার শুনেছি রাইসুর স্কুল জীবনের সহপাঠী তুহিনের কাছে। সহপাঠী হলে যেমন অধিকার নিয়া বলা তেমন করেই তুহিন রাইসুর প্রসঙ্গ তুলত। সেইসব গল্পের সারাংশ দাঁড়াত রাইসু মেধাবী এবং বোহেমিয়ান।

রাইসু খিঁলগাও গভমেন্ট স্কুলের ছাত্র ছিলেন। রাইসুর চিন্তার জগৎ বন্ধুদের অনেকের কাছে বোধগম্য হওয়া কঠিন। রাইসুর চিন্তাগুলো কোনো টেক্সটের ধারাবাহিকতায় পড়ে না। এগুলো অ্যামিবার মতো স্থিতিস্থাপক। তাঁর চিন্তা নিজের ভেতর থেকে উৎসারিত। এজন্য রাইসুর চিন্তার জায়গাটা অন্যদের থেকে আলাদা। রাইসুর কবিতা, মতামত সব তার মতই। রাইসুর কাজ পুরানো ঘর সংস্কার নয়, ভেঙে নতুনভাবে গড়ে তোলা। এজন্য অনেক প্রতিষ্ঠিত ধারণা নাকচ করে বিকল্প ধারণা তুলে ধরেন।

রাইসুর জীবন সংগ্রাম কঠিন মনে হতে পারে, কিন্তু জীবনরে তিনি সহজ করে নিয়েছেন। ঈর্ষা ও বৈরিতা মোকাবেলা করার সক্ষমতা রাইসুর আছে। নতুন এক পরিবর্তিত সমাজে শিল্পবোধের যে পরিবর্তন ঘটায়, রাইসুর লেখায় তা প্রতিফলিত হয়।

চটি পায়ে রাইসুকে আমি যেমন দেখেছি, এখনো রাইসুকে সেই বিপ্রতীপ দার্শনিক রেখার ওপর দিয়ে হাঁটতে দেখি। আলাপে আনন্দ ও গভীরতা পাই।

ব্রাত্য রাইসুকে আমি আন্তরিক অভিবাদন জানাই।

২০/১১/২০১৭

 

Leave a Reply